ছোটোবেলায় এক বড়োভাই বলেছিলেন, ‘সব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয়ে গেছে। নিউটন আইনস্টাইনেরা সব করে গেছেন। এখন আমাদের গবেষণার কিছু বাকি নেই। বাংলাদেশে ভালোভাবে খেয়ে-পরে বাঁচতে গেলে গৎবাঁধা সরকারি চাকরি ছাড়া আর করার কিছুই নেই।’
কথাটা তখন বিশ্বাস হলেও ভুল ভাঙে কিছুদিন পরেই। যাঁকে পৃথিবীর সবচাইতে মেধাবী বিজ্ঞানী বলা হয়— সেই আইনস্টাইন নিজেও অনেক কাজ শুরু করে শেষ করে যেতে পারেননি। তাঁর সেই শেষ না-হওয়া কাজগুলো আজও মানুষ করে যাচ্ছে। শেষ করার প্রয়াসে। নতুন কিছু পাওয়ার সন্ধানে। সুদূর আইনস্টাইনের কাছে যেতে হবে না। আমার আপনার আশেপাশে অসংখ্য সমস্যা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে খেয়ে যাচ্ছে। যে সমস্যা শুধু আমার আপনার গবেষণা, তার বাস্তব প্রয়োগ আর আমাদের সততা সমাধান করে দিতে পারে। গবেষণার উদ্দেশ্য হতে হবে মানুষের উপকার। যে সমস্যা সমাধান করে আপনি অন্য কাউকে উপকৃত করলেন বা নিজেকে উপকৃত করলেন সেটা শুধু সেখানেই থেমে থাকবে না। ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা, বৃত্তি, ভালো ক্যারিয়ারের দিকেও আপনাকে নিয়ে যাবে। এগুলোর যেকোনো একটিই হতে পারে— ‘কেন আপনি গবেষণা করবেন?’ তার উত্তর।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের শেষের দিকে আর মাস্টার্সে পড়ালেখা চলাকালেই গবেষণা শুরু করার জন্য উপযুক্ত সময়। আর আপনি যদি উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, বৃত্তি, ফেলোশিপ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী হন তাহলে তো অবশ্যই। অনার্স বা মাস্টার্সে অনেকেই বাধ্যতামূলক থিসিস বা প্রজেক্ট করে থাকেন। কিন্তু কতজন সত্যিই গবেষণা করেন? আর কতজনের গবেষণা আর সাতটা মানুষকে সত্যিই সাহায্য করতে পারে? সংখ্যাটা খুবই কম। তাই খুবই কম মানুষ গবেষণা করে সফল হয়েছেন। কিন্তু যাঁরা সফল হয়েছেন, তাঁদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়।
সফলতার কোনো শর্টকাট নেই। আপনি পরিশ্রম করে নিজেকে যেখানে নিয়ে যাবেন নিজেকে সেখানেই পাবেন। সেই পথে যদি আপনার গবেষণা কোনো মানুষের কাজে লাগে তাহলে আপনি হয়তো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
খুব সাধারণ একটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা যাক। আপনার প্রতিবেশী এক কৃষক ধান চাষ করেন। সময়মতো তাকে পানির মেশিন চালু করতে হয়। রোদ, বৃষ্টি, আবহাওয়া, পোকা-মাকড় অনেক কিছু মাথায় রেখে ঠিক সময়ে তাঁকে সঠিক কাজ করে ফসল ফলাতে হয়। আপনি সিএসিইতে (কম্পিউটার-বিজ্ঞান ও প্রকৌশল) পড়ছেন কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে আপনি তাঁকে (কৃষক) কীভাবে সাহায্য করতে পারেন? উত্তরটা খুব সহজ। একটি ধান ক্ষেতে নানারকম সেন্সর ব্যবহার করা যায়। জমির মাটিতে পানির পরিমাপ, পিএইচ, ক্ষতিকর পদার্থ ইত্যাদি পরিমাপ করা যেতে পারে সেন্সরের মাধ্যমে। পোকামাকড়, পাতার অবস্থা ইত্যাদি নির্ণয়েও ইমেজ প্রসেসিং পদ্ধতি আছে। তো একটি সিস্টেম তৈরি করা যায় যা ক্ষেতের কোনো এক জায়গায় স্থাপন করা হবে।
এর ফলে কিছু সেন্সর থাকবে, থাকবে মাইক্রোকন্ট্রোলিং ইউনিট। জমি থেকে তথ্য নিয়ে যা সার্ভারে পাঠাবে। সার্ভারের ডাটাবেজে থাকবে আগে থেকে ট্রেইন করা মেশিন-লার্নিং মডেল। যার সাথে তুলনা করা হবে সদ্য প্রাপ্ত তথ্যের। প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত চলে যাবে কৃষকের মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা বা এসএমএস হিসেবে। ধানখেতের পানির পরিমাপ অনুযায়ী, নিজ থেকে চালু বা বন্ধ হবে পানির পাম্প। বাঁচবে বিদ্যুৎ। বেশ কিছুদিন ধরে এই সিস্টেম চলতে থাকলে সার্ভারে জমা হবে আরো অনেক উপাত্ত। এগুলোর মাধ্যমে নির্ধারণ করা যাবে আগামী বছর ঠিক কীভাবে কী কী করলে ভালো ফলন হতে পারে। বিষয়টা কিন্তু খুব কঠিন কিছু নয়। যদি সত্যিই আপনি এভাবে নতুন কিছু করে মানুষের উপকারী কিছু তৈরি করতে পারেন, তো আপনার ক্যারিয়ারে পথচলা কিন্তু থেমে থাকবে না। আপনার পরিশ্রম নিয়ে যাবে আপনার স্বপ্নের কাছে।
আশেপাশে তাকান, একটি সমস্যা সমাধানের আইডিয়া বের করুন, তা নিয়ে পড়ালেখা করুন। সেই সম্পর্কিত রিসার্চ পেপার খুঁজে বের করুন। পড়ুন। তারপর বাস্তবায়ন করুণ আপনার ভাবনা, চিন্তা। যে কাজের ফলে আপনার জীবন এগিয়ে যেতে পারে অনেক দূর। সেই কাজটা আদতে খুব সহজ হবে না। সফলতার কোনো শর্টকাট নেই। আপনি পরিশ্রম করে নিজেকে যেখানে নিয়ে যাবেন নিজেকে সেখানেই পাবেন। সেই পথে যদি আপনার গবেষণা কোনো মানুষের কাজে লাগে তাহলে আপনি হয়তো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আপনি না-থাকলেও আপনার কাজের মাঝে আপনি বরণীয় হবেন প্রতিদিন।